বাঙ্গালীর বার্তা: উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ সংকটের কারণে একদিকে যেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, অন্যদিকে নতুন কোনো শিল্প গড়ে উঠছে না। ফলে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, শিল্প খাতে গ্যাস সংযোগ দিলে এ অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থানও হবে বহু মানুষের।
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল) ২০১৩ সালে রাজশাহীতে আবাসিক ও ৪০টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে গ্যাস সংকটের কারণ দেখিয়ে সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এদিকে বিকল্প উপায়ে গ্যাস ব্যবহারে খরচ অনেক। ফলে সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে শিল্প খাতে ‘বিপ্লব’ ঘটার সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীতে গড়ে ওঠা ‘এমএইচ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড’র উদ্যোক্তা হাফিজুর রহমান জানান, ২০০২ সালে ২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগে কোম্পানিটি গড়ে তোলেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালে গ্যাস সংযোগের জন্য আবেদন করে নির্ধারিত টাকা জমা দিয়েও তিনি সংযোগ পাননি। বাধ্য হয়ে এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন। এতে মাসে গ্যাস বাবদ খরচ হচ্ছে ৩ লাখ টাকা, যেখানে পাইপলাইনের সংযোগ পেলে বিল হতো মাত্র ৩০ হাজার টাকা। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিসিকের আরও অনেক উদ্যোক্তা একই সমস্যায় ভুগছেন। কারও কারও প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যারা টিকে আছেন, তাদের অবস্থাও করুণ। ‘এডভেন্ট বিডি কোম্পানি’র মালিক মোখলেছুর রহমান মুসা জানান, গ্যাস সংযোগ থাকলে মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হতো, কিন্তু এখন সিলিন্ডারে খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। গ্যাস সংকট ছাড়াও পণ্য পরিবহনের সহজ কোনো ব্যবস্থা না থাকায় উত্তরাঞ্চলের শিল্প খাত পিছিয়ে পড়ছে। রাজশাহীতে নেই কোনো নদী বা সমুদ্রবন্দর, নেই কার্গো বিমান পরিষেবা কিংবা চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রার মতো প্রধান বন্দরগুলোর সঙ্গে সরাসরি রেল সংযোগ। এতে শিল্পপণ্য পরিবহন ব্যয় এবং সময় উভয়ই বেড়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী রেশম শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বাঙ্গালীর বার্তাকে বলেন, পদ্মা নদীতে ড্রেজিং করে নৌবন্দর করা যেতে পারে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি রেল সংযোগ চালু করতে হবে।
পিজিসিএল সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে বর্তমানে ১৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ রয়েছে। আরও চারটি প্রতিষ্ঠান সংযোগের জন্য আবেদন করে বছরের পর বছর অপেক্ষায় রয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ ও পাবনাসহ বিভিন্ন জেলায় কয়েকশ’ ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অধিকাংশই গ্যাসের অভাবে সিলিন্ডারনির্ভর। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বগুড়ায় নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়তে ‘উত্তরাঞ্চল কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প পার্ক’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান বগুড়া বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) একেএম মাহফুজুর রহমান। প্রায় ৩০০ একর জমিতে ২ হাজার প্লটের এ প্রকল্পে ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। এখানে দুগ্ধজাত পণ্য, আলু, মরিচ, মাছসহ কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠবে, যা ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বগুড়ায় এখন শিল্প নগরীর ভেতরে থাকা ৯৪টি শিল্প কারখানা থেকে রাজস্ব ওঠে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। আর প্রস্তাবিত শিল্প পার্ক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হবে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, সবজিসহ পচনশীল অনেক কৃষিপণ্য নষ্ট হওয়া বন্ধ হবে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদর রহমান রিংকু বাঙ্গালীর বার্তাকে বলেন, গত ১০ বছরে রাজশাহীতে মাত্র দুটি বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। অথচ এখানে হিমাগার, মিঠা পানির মাছ ও পান প্রসেসিং ইউনিটসহ অনেক সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট না থাকলে বিনিয়োগ বাড়ত।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইদুর রহমান বাচ্চু এবং বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস সংযোগ দিলে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পিজিসিএলের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী বরকত হোসেন মোল্লা বলেন, তথ্য অধিকার আইনের আওতায় লিখিত আবেদন ছাড়া তথ্য দেওয়া যাবে না।