বাঙ্গালীর বার্তা: প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকায় হাঁসফাঁস অবস্থায় দিন কাটছে সাধারণ মানুষের। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ব্যবসাবাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান আরও নিম্নগামী হয়েছে। এমন সময় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট দিতে গিয়ে সংযত অর্থনীতির পথে হেঁটেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমানো হয়েছে বাজেটের আকার। তারপরও প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নাকাল ভোক্তার ওপর থেকে চাপ সরানোর সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেই এই বাজেটে। তাই সংকোচনমুখী অর্থনীতিতে বিশাল আকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গিয়ে ঘাম ছুটবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত সোমবার উপস্থাপন করা বাজেটে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুই দিক থেকেই চাপ বাড়ছে এবং পরিস্থিতি শিগগিরই পরিবর্তন হবে এমন লক্ষণও নেই। এই পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের এই লক্ষ্যমাত্রা বিশাল। একই সঙ্গে তারা এনবিআরকে রাজস্ব আহরণে বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা প্রদানের পাশাপাশি সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। এমন পরিস্থিতিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার পথনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। ফলে এনবিআরের পক্ষে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। সব মিলিয়ে অর্থবছরে পুরো সময়ই রাজস্ব আহরণে চাপে থাকবে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে, বিশ^ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনেকটা অসম্ভবই।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রায় যে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা অর্জন করা কঠিন হবে। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাকে বড়-ই বলা যায়।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম বলেন, গত অর্থবছরেও লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে আমরা মনে করছি। তিনি আরও বলেন, বাজেটে বিভিন্ন ধরনের পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ দেখা গেলেও প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধির তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পরোক্ষ কর বৃদ্ধির কারণে দেশের সাধারণ মানুষকে এর ভার বহন করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রতিদিন এনবিআরকে ১ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। এর মধ্যে আয়কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৬ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা বেশি। মূল্য সংযোজন কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা বেশি। এতে সব মানুষের ওপর করের চাপ বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সম্পূরক শুল্ক আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা বেশি। আমদানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫১ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৬৭৪ কোটি টাকা বেশি। রপ্তানি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৮ কোটি টাকা বেশি। আবগারি শুল্কের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ২৮৬ কোটি টাকা বেশি। অন্যান্য কর আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে ৬৫০ কোটি টাকা বেশি।

রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের ওপর চাপটা থাকবে বেশি। তবে এ চাপ এনবিআরের জন্যও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায়ে বরাবরের মতো এবারও চাপে থাকতে হবে এনবিআরকে। বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আহরণের জন্য যে ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতি সংস্কার এবং অন্যান্য সক্ষমতা দরকার সেসব ক্ষেত্র অনেক বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আরও বলেন, যদি আমরা রাজস্ব পদক্ষেপ দেখি, যেটা সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে যে, কর কাঠামোর মধ্যে করের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। কিন্তু প্রায় ৩ বছরের মতো সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, ১০-১১ শতাংশে উঠে গেছে। করের বিভিন্ন স্ল্যাবগুলোতে পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে যারা নিম্ন মধ্যম আয়ের মধ্যে পড়েছেন, কর দেওয়ার ক্ষেত্রে হারটা তাদের মধ্যেই বেশি পড়বে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন ‘আমাদের কাছে আশ্চর্য লাগছে মিডিয়াম-টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি স্টেটমেন্ট, সেখানে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে রাজস্ব জিডিপির রেশিও ২০৩৫ সালে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। এটা অত্যন্ত কম, কারণ প্রস্তাবিত অর্থবছরে রাজস্ব হার ৯ শতাংশ জিডিপির অনুপাতে। ১০ বছর পর মাত্র দেড় শতাংশ বাড়বে, এটা কেমন লক্ষ্যমাত্রা! তখন তো আমরা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে যাব। এখানে আমরা দেখছি আকাক্সক্ষার নিম্নকামিতা। এত কম আকাক্সক্ষা নিয়ে আমরা কীভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করব? সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা উচ্চাকাক্সক্ষা দেখতে পাচ্ছি না।’

সিপিডির সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান আমাদের সময়কে বলেন, বাজেটটি সংযত অর্থনীতির ধারবাহিকতায় করা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটের ভিত্তিতে করা হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে সংশোধিত বাজেট অর্জিত হবে না।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরি করে এনবিআরকে বড় ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যার কারণে সংস্থাটি তা অর্জন করতে পারে না, এটা প্রতিবছরই ঘটছে। অর্থনীতির আকারযেভাবে বাড়ছে, রাজস্ব আদায় সেহারে হচ্ছে না।

সুত্র: বা,প্র