বাঙ্গালীর বার্তা: দিনাজপুর জেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে বিরল উপজেলার কাঞ্চন মোড়। সড়কের পাশে জীবন মহল বিনোদন কেন্দ্র। পার্কের সামনে শতাধিক দোকান। গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টায় গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক তালাবদ্ধ চারিদিকে কেমন যেন নিস্তব্ধ অবস্থা দর্শনার্থী নেই। কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা। জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। সাংবাদিক পরিচয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ধ্বংসস্তূপ। সর্বত্র গত বৃহস্পতিবারের হামলার ক্ষতচিহ্ন।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রধান ফটকটি ভাঙা। পাশে উল্টে ফেলে রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য নির্মিত ট্রেনসহ বিভিন্ন খেলনা। ভেঙে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন প্রাণী ও পরীর মূর্তি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ভাঙা চেয়ার।
জীবনীয়া দরবার শরিফ ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ছবি
আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দরবার শরিফ। এতে পুড়ে গেছে ধর্মীয় বই, দাতব্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধপত্র ও অন্য সামগ্রী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দরবার শরিফ সংলগ্ন জামে মসজিদ। কেটে ফেলা হয়েছে গাছ। ভাঙা হয়েছে দুটি মাইক্রোবাস ও পাঁচটি মোটরসাইকেল। লুটপাট করা হয়েছে দরিদ্রদের জন্য বিনাসুদে ঋণ দেওয়া অফিসের টাকাপয়সা। সিসি ক্যামেরা, ১৫টি টেলিভিশন ও ফ্যান তছনছ করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে হোয়াইট হাউস নামে রিসোর্টের প্রতিটি কক্ষের দরজা-জানালাসহ আসবাব। পিকনিক স্পটের টেবিলগুলো কোপানো হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে টিকিট কাউন্টার।
বিনোদন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মজিবুর রহমান জানান, পৈতৃক ছয় একর জমির ওপর আনোয়ার চৌধুরী জীবন ২০০৪ সালে বিনোদন কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০১৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসে। শিশুদের উল্লাসে মুখর থাকে পার্কটি। ১৬ আগস্ট ছয়জন ৪০ ঊর্ধ্ব নারী-পুরুষ জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে রিসোর্টে ওঠেন। সন্ধ্যার দিকে প্রশাসন অভিযান চালায়। দুজনকে ছেড়ে দেয়। দুজনকে জেল-জরিমানা করে। সেই সঙ্গে জীবন মহলকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে। এ নিয়ে ফেসবুকে উস্কানি ছড়ায় একটি পক্ষ। ঘোষণা দিয়ে ১৮ আগস্ট ‘তৌহিদী জনতা’র নামে ৪০-৫০ জন মিছিল নিয়ে জীবন মহলের সামনে এসে বিক্ষোভ করে। এর প্রতিবাদে এলাকার সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা গত বৃহস্পতিবার জীবন মহলের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দেয়। অন্যদিকে, ফেসবুকে রেদোয়ানুল হক নামের এক আইডি থেকে ‘তৌহিদী জনতা’কে এক হতে ঘোষণা দেওয়া হয়। আশপাশের উপজেলায় মাইকিং করা হয়। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায়। তার পরও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে প্রায় চার হাজার ‘তৌহিদী জনতা’ এক হয়ে পার্কে হামলা চালায়। তারা পিকআপে পাথর ছাড়াও দেশি অস্ত্র নিয়ে আসে। প্রধান ফটক ভেঙে তারা প্রথমে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। সিসি ক্যামরাগুলো ভাঙে। এরপর এক পক্ষ ভাঙচুর, এক পক্ষ অগ্নিসংযোগ এবং অন্য পক্ষ লুট চালায়। তাদের হামলায় গুরুতর আহত কর্মচারী মঞ্জুরুল আলমকে (৪০) ঢাকা, মিজানকে (৪৮) দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে পান্না, লাইলী, ভূষণ, তৈমুর, নজরুলসহ ২০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।
বিনোদন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের ওপর ১০০ কর্মচারীর পরিবার নির্ভরশীল। দর্শনার্থীদের মাধ্যমে ভেতরে ও বাইরে দুই শতাধিক দোকানের বেচাকেনা হয়। আমরা এই তাণ্ডবে হতাশ হয়ে পড়েছি। বেঁচে আছি, এটাই আশ্চার্য লাগে!’
বাইরের চা দোকানদার আ. হালিম বলেন, ‘এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও বিনাসুদে ঋণ দেওয়া হয়। তৌহিদী জনতার নাম দিয়ে মসজিদ ভাঙা হয়েছে। গতকাল এই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে পারেননি স্থানীয় মুসল্লিরা। এই বিনোদন কেন্দ্র না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুই শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।’
বিনোদন কেন্দ্রটির মালিক আনোয়ার চৌধুরী জীবন বাঙ্গালীর বার্তাকে বলেন, তিনি একসময় সিনেমা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনা করতেন। চলচ্চিত্র ব্যবসায় ভাটা পড়লে তিনি এলাকায় বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। এবারও নির্বাচন করার ইচ্ছা ছিল। তিনি বলেন, ‘সুনাম ক্ষুণ্ন করতে প্রতিদ্বন্দ্বিরা তৌহিদী জনতার নামে এ হামলা করে থাকতে পারে। হামলাকারীরা কেউ এলাকার ছিল না। সবাই অপরিচিত ও বাইরে থেকে আসা।’ তিনি আরও জানান, তিন কোটি টাকার ক্ষতি ছাড়াও নগদ ১৩ লাখ টাকার বেশি লুট করা হয়েছে। তিনি রোববার মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সহপ্রচার সম্পাদক ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. তোজাম্মেল হক বলেন, ‘জীবন চৌধুরী দানবীর ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর বিনোদন কেন্দ্রের কারণে অনেকের সংসার চলছে। এলাকার মানুষের উপকার করেন। তৌহিদী জনতার নামে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করা মোটেও ঠিক হয়নি।’
বিরল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুস সবুর বলেন, ‘সংঘর্ষ, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এখন পর্যন্ত মামলা দিতে কোনো পক্ষ থানায় আসেনি।’