বাঙ্গালীর বার্তা: অবশেষে শরিয়াহভিত্তিক দুর্বল পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি বৃহৎ ইসলামি ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে ওই ব্যাংকগুলোকে অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর বোর্ড ভেঙে দিয়ে প্রশাসক বসানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, একীভূত হওয়া পাঁচটি ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষিত থাকবে, তাঁদের কোনো ভয় নেই। কেউ চাকরিও হারাবেন না। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, পরিচালক ও একীভূত প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংককে অকার্যকর ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কোম্পানি সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে এ ঘোষণার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া বুধবার (গতকাল) থেকেই ব্যাংকগুলো বোর্ড বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বোর্ড সদস্যরা ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ। একই সঙ্গে কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোতে অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ব্যাংকে একজন করে প্রশাসক এবং তাঁর সহযোগী দল দায়িত্ব পালন করবে।
গভর্নর জানান, অস্থায়ী প্রশাসনকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো যেন কার্যকরভাবে চালু থাকে এবং বড় অঙ্কের পেমেন্ট, রেমিট্যান্স ও এলসি সেটেলমেন্ট স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। এ জন্য আইটি অবকাঠামো একীভূত করে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা, কর্মী সংখ্যা ও মানবসম্পদ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস এবং একই এলাকায় ব্যাংকগুলোর একাধিক শাখা থাকলে তা যৌক্তিকভাবে একীভূত করতে বলা হয়েছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং একটি সক্ষম ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান তৈরি করা। নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে সরকারি মালিকানাধীন হলেও পরিচালনা হবে পেশাদার ব্যবস্থাপনা ও বোর্ডের মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকের মতো। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের যে কোনো ব্যাংকের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এটি হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ব্যাংকটিতে শরিয়া নীতির ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংকিং সিস্টেমে পরিচালিত হবে।
আমানতকারীদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, নতুন ব্যাংকটি সরকারি মালিকানাধীন হওয়ায় আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। একীভূতকরণের দিন থেকেই বাজারভিত্তিক মুনাফার হার অনুযায়ী লাভ দেওয়া হবে। ব্যাপক অর্থ উত্তোলন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেসব আমানতকারীর ২ লাখ টাকা বা তার কম জমা রয়েছে, তাঁরা সম্পূর্ণ অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন। এর বেশি টাকার আমানত ধাপে ধাপে উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হবে, যা পরবর্তীতে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জানানো হবে। এই মার্জার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৭৫ লাখের বেশি আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষিত থাকবে।
পরবর্তী সরকার এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে কি না- এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জাবাবে আহসান এইচ মনুসর বলেন, এ মার্জার প্রক্রিয়া জনগণ, দেশ এবং আর্থিক খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য। এর সফল বাস্তবায়ন আগামী সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের ইতিবাচক স্থিতিশীলতা আনবে এবং অর্থনীতিতে আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রায় ৭৫ লাখ আমানতকারীর স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হবে।
একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগবে- এমন ইঙ্গিত দিয়ে গভর্নর বলেন, একীভূতকরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। এটি একদিনে, এক মাসে বা ছয় মাসে সম্পন্ন হবে না। ধাপে ধাপে এগিয়ে নেওয়া হবে। যত দ্রত সম্ভব একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। আমাদের আশা এই উদ্যোগটি ভবিষ্যৎ সরকারও বজায় রাখবে।
এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটির মূল্য এখন নেগেটিভ। তাই তাঁদের শেয়ারের ভ্যালু শূন্য (জিরো) হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কাউকেই কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক যেমন লভ্যাংশ পান, তেমনি ক্ষতির দায়ও নিতে হয়। আমরা এখানে শেয়ারহোল্ডারদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি না, কেবল তাঁদের শেয়ারমূল্যকে শূন্য ধরা হচ্ছে।
এর আগে গত ৯ অক্টোবর সরকারি মালিকানাধীন ইসলামী ব্যাংক গঠনের অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত হয়। মূলত গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছেÑ তারল্য সংকট, বিশাল অঙ্কের শ্রেণিকৃত ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি এবং মূলধন ঘাটতি- এসব কারণে ব্যাংকগুলো কার্যত দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। অনেকবার তারল্য সহায়তা দেওয়ার পরও এই ব্যাংকগুলোর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
প্রশাসকের দায়িত্ব পেলেন যাঁরা : এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শওকত উল আলমকে। নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদার ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও মো. সালাহ উদ্দীন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্যদিকে পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেমকে ইউনিয়ন ব্যাংক ও মাকসুদুজ্জামানকে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেক প্রশাসকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা সংযুক্ত করা হয়েছে।