বাঙ্গালীর বার্তা: রাজধানীতে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির নজির চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ভোগান্তির অন্ত থাকে না নগরবাসীর। জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রতি বছর সিটি করপোরেশন থেকে নানান উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। এর মূল কারণ পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকার কারণ হিসেবে বারংবার উল্লেখ করেছেন নগরবীদরা।
পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতিকরণ এবং বর্জ্য অপসারণের গুরুত্বারোপ নিয়ে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করলে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে জলাবদ্ধতা। অল্প বৃষ্টিতেই নাকানি-চোবানি খেতে হয় নগরবাসীর। জলাবদ্ধতার পেছনে নগরবাসীর দায় কতটুকু তা নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদনে।
স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি হলেই রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, মহাখালী, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বিভিন্ন অলিগলিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে যায়। এছাড়াও যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, নারিন্দা, দয়াগঞ্জ, টিকাটুলি, স্বামীবাগ ও গেন্ডারিয়ায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। দুদিন আগের বৃষ্টিতেও এসব জায়গায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এসব এলাকায় ধারাবাহিকভাবে ড্রেনেজ পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা- ২ মো. রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মাসের ভিতর অনেক এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা দু’বারও পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার জলাবদ্ধতা হয়। কারণ নগরীর বাসিন্দারা যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে। আর তা গিয়ে পড়ে ড্রেনে। আর ড্রেনে ময়লা আবর্জনা জমাট বাধার ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যাঘাত ঘটে। আর তখনই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার।
ড্রেন থেকে বস্তা বস্তা ময়লা-আবর্জনা উদ্ধার
বুধবার (৩০ জুলাই) পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় দেখা যায়, ড্রেন থেকে বস্তায় ভরে ভরে ময়লা আবর্জনা তুলছেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। এছাড়াও সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বংশাল, দয়াগঞ্জ ও নারিন্দা এলাকায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো। সেখানকার একই দশা।
ড্রেন থেকে বের করা ময়লা আবর্জনার মধ্যে দেখা যায়, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, বাসা বাড়ি থেকে ফেলা ময়লা আবর্জনা এমনকি পুরোনো জামাকাপড়ও আছে। এছাড়াও পুরোনো আসবাবপত্রের ভাঙাচোরা অংশ এবং পুরোনো ছেঁড়া জুতো ড্রেন থেকে বের করতে দেখা যায়।
পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা সবুজ নামের একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্ষাকালের আগ থেকেই সিটি করপোরেশনের পরিছন্নতা কার্যক্রম চলমান আছে। প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন এলাকার ড্রেন থেকে কয়েক হাজার বস্তা করে ময়লা আবর্জনা ড্রেন থেকে বের করি। তারপর সেগুলো সিটি করপোরেশনের আর এক দল কর্মী এসে নিয়ে যায়।’
সিটি করপোরেশনের আরেকজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলেন, ‘ড্রেন থেকে উদ্ধার করা ময়লার মধ্যে বেশিরভাগ থাকে পলিথিন প্লাস্টিক। এসব পলিথিন প্লাস্টিক ড্রেনের মোড়ে এসে জমাট বেঁধে থাকে। যার কারণে ঠিকমতো পানি চলাচল করতে পারে না। আমাদের ডিউটিতো এইসব ময়লা আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করা। কিন্তু, দিনশেষে ভোগান্তি তো এলাকার মানুষকেই করতে হয়। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতায় তাদের জামা কাপড় নোংরা হয়। তারা যদি পলিথিন প্লাস্টিক ড্রেনে না ফেলে তাহলে কিন্তু আর কষ্ট পোহাতে হবে না।’
জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে নগরবাসীর দায় কতটুকু?
রাজধানীতে হাঁটলেই প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে, মানুষজন অনায়াসে চিপস বা বিস্কুটের প্যাকেট এমনকি কোকের বোতল ছুঁড়ে ফেলছে রাস্তার ওপরে। সেই প্যাকেট বা বোতল গিয়ে পড়ছে রাস্তার পাশে ড্রেনে। এই দৃশ্য প্রতিদিনকার। ময়লা আবর্জনা ফেলার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ডাস্টবিন স্থাপন করা হলেও—যথাযথ ব্যবহার করতে দেখা যায় না তেমন কাউকে।
বংশাল এলাকা দিয়ে হাঁটতেই চোখে পড়ে এক যুবক পানীয় পান করে বোতলটি রাস্তা পাশে ছুঁড়ে ফেলেছে। কথা বলে জানতে পারি, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। রাস্তার পাশে বোতল ছুঁড়ে ফেলার কারণ জানতে চাওয়ার পর তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আশেপাশের ডাস্টবিন নেই তাই এখানে ফেলেছি। তাছাড়া সবাই ফেলছে আমি ফেললে তো দোষের কিছু না। আর এজন্য তো জেল জরিমানা হবে না।’
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক নজরুল মুন্সি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নগরবাসী দায়িত্ব নিয়ে যথাযথ জায়গায় ময়লা আবর্জনা ফেললে নগরীর অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের অভ্যাস যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা। সেই ময়লা আবর্জনা গিয়ে পড়ে ড্রেনে। পরে ড্রেন ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। এরপরেই তো শুরু হয় আসল সমস্যা। একটু বৃষ্টি হলেই এলাকার অলিগলিতে পানি জমে যায়। কারণ পানি নিষ্কাশনের পথ তো ময়লা আবর্জনায় ভরাট।’
রাজধানীতে প্রয়োজনের তুলনায় ডাস্টবিনের সংখ্যা অপ্রতুল হলেও আমাদের সদিচ্ছা পারে শহরটাকে সুন্দর করে রাখতে বলে মন্তব্য করেছেন এই শিক্ষক। তিনি আরও বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পাড়া মহল্লায় ডাস্টবিন স্থাপন করা জরুরি। দেখা যায় অনেক অলিগলি পাড়া মহল্লাতে বাসা বাড়ির ময়লা আবর্জনা সব রাস্তার ওপরেই ফেলে রেখে যায়। সেসব ময়লা আবর্জনা আবার গড়িমসি খেয়ে ড্রেনে পড়ে। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় আমাদের সচেতন হতে হবে এবং দায়বদ্ধতা থেকে ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে।’
রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন নগরবাসীর সহযোগিতা
রাজধানীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি নগরবাসীরও দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্সের (বিআইপি) বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার যে আলাপ, সেটা কিন্তু দীর্ঘদিনের। কিন্তু তার আগে আমরা যারা রাজধানীতে বসবাস করছি তাদের সচেতন হতে হবে। কারণ আমাদের অসচেতনার কারণে শহর অপরিচ্ছন্ন হচ্ছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হচ্ছে ময়লা আবর্জনা জমে। আমরা সচেতন হলে জলাবদ্ধতা কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে।’
চলবে…