বাঙ্গালীর বার্তা: প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে নির্বাচন করার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ডিসেম্বরের শুরুতে তফসিল আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের সময় ধরে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে সংস্থাটি।
তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মধ্যে যখন নানা মত তখন রোডম্যাপ ঘোষণা হলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ রোডম্যাপ পেয়ে বিএনপি এবং তাদের সমমনা জোটের নেতারা যখন স্বস্তি প্রকাশ করছেন তখন পুরোপুরি ভিন্ন মত জামায়াত ও এনসিপির। সংস্কার ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার আগে নির্বাচনের তফসিলকে অপরিপক্ব ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হিসেবে দেখছেন এই দুই দলের নেতারা।
“আমি পুরোপুরি উদ্বিগ্ন। কারণ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও মতবিরোধ আছে। যেসব দল মাঠে আছে তারাই তো এক কাতারে আসেননি। আপনি কীভাবে নির্বাচন করবেন?”
—অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
একইসঙ্গে জামায়াত-এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এই তিন দলের নেতারা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে রোডম্যাপ দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ ঘোষণা কীভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্ন করা হলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আমি পুরোপুরি উদ্বিগ্ন। কারণ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও মতবিরোধ আছে। যেসব দল মাঠে আছে তারাই তো এক কাতারে আসেননি। আপনি কীভাবে নির্বাচন করবেন?
ঢাকা মেইলকে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটা মোকাবিলার করার মতো মানসিকভাবে প্রশাসন কতটা প্রস্তুত সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
যেভাবে রোডম্যাপ সাজিয়েছে ইসি
বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন কমিশন ভবনে কমিশন সচিব আখতার আহমেদ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এরআগে বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন এই রোডম্যাপ অনুমোদন করে। ২৪টি কাজের পরিকল্পনার মধ্যে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের কথাও রয়েছে।
সংলাপ, মতবিনিময়, মিটিং, ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ, মুদ্রণ, বাজেট বরাদ্দ, আইটিভিত্তিক প্রস্তুতি, প্রচারণা, সমন্বয় সেল, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকে যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা মাথায় রেখে উল্লেখযোগ্য খাত ও বাস্তবায়ন সূচি রোডম্যাপে স্থান পেয়েছে।
“নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেটা মোকাবিলার করার মতো মানসিকভাবে প্রশাসন কতটা প্রস্তুত সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত”
—ড. দিলারা চৌধুরী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
রোডম্যাপের প্রতিক্রিয়ায় কোন দল কী বলছে?
রোডম্যাপ ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা খুশি, উই আর হ্যাপি।’
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এই বিষয়টিকে তারা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
“আমরা খুশি, উই আর হ্যাপি”
—রোডম্যাপ ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল
তিনি বলেন, যথাযথ সময়ে রোডম্যাপটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকেও একই রকম নির্দেশনা ছিল। এখন রোডম্যাপ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তবে বিএনপি যখন খুশির কথা বলছে তখন রোডম্যাপকে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত আখ্যা দিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে।
“জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি”
—অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সেক্রেটারি জেনারেল, জামায়াত
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ গতানুগতিক এবং কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। এতে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি।
আর পিআর পদ্ধতিতে ভোট, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির আগে নির্বাচন না করার দাবি জানিয়ে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতা রোডম্যাপ ঘোষণাকে সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, আমরা মনে করি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য নির্বাচন আয়োজন প্রয়োজন, আমরা কোনোভাবেই নির্বাচন বিরোধী নই। সেদিক থেকে রোডম্যাপ যোষণা ইতিবাচক তবে, যতো দ্রুত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে, ততো দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া যাবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে। এর যার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
এদিকে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে সরব ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, জাতি সংবিধান, রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক সংস্কারের জন্য অধীর অপেক্ষা করছে। মৌলিক সংস্কারের সামান্যতমও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই অন্য যে কোনো রোডম্যাপের আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দিতে হবে।
রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিকল্প নেই। তবে যে সময় আছে তার মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সংস্কার, বিচার এগুলোও এগিয়ে নেওয়া উচিত।
—শাহাদাত হোসেন সেলিম, চেয়ারম্যান, বিএলডিপি
তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা পুরোনো অশুভ রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা ছাড়া কিছু না।
তবে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, রোডম্যাপ বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিকল্প নেই। তবে যে সময় আছে তার মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সংস্কার, বিচার এগুলোও এগিয়ে নেওয়া উচিত।
রোডম্যাপ ঘোষণা করে ইসি পুরোদমে নির্বাচনী ট্রেনে উঠে গেল। মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আশা করি নির্বাচন কমিশন তাদের ঘোষিত সময়ের মধ্যেই পুরো কাজ শেষ করতে পারবে।
—অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, চেয়ারম্যান, এনপিপি
নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে যে দল যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত তারা বিদ্যমান অবস্থায় নির্বাচনে আসবে বলে মনে করেন এই রাজনীতিক।
একই ধরনের মন্তব্য সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদেরও।
ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, রোডম্যাপ ঘোষণা করে ইসি পুরোদমে নির্বাচনী ট্রেনে উঠে গেল। মানুষ ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আশা করি নির্বাচন কমিশন তাদের ঘোষিত সময়ের মধ্যেই পুরো কাজ শেষ করতে পারবে।