বাঙ্গালীর বার্তা: ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ঘটে যাওয়া এক চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। সাবেক স্ত্রীর সঙ্গে আবারও বিয়ের বিষয়ে বিবাদের জেরে বিথী আক্তার (৩০), তার চার বছর বয়সী শিশু রাফসান ও ভাড়াটিয়া তরুণী নূপুর (২৫)–এই তিনজনকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মহিউদ্দিন হাওলাদার ওরফে শিমুল (৩১)। এরপর ঠান্ডা মাথায় তিনটি লাশই টুকরা করে বস্তাবন্দি করে ফেলে দেন বিভিন্ন স্থানে।
গত শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ মাকসুদা গার্ডেন সিটির সামনে থামে একটি অটোরিকশা। এক যাত্রী নামেন হাতে প্লাস্টিকের একটি বড় বস্তা নিয়ে। রিকশা চলে যাওয়ার পর বস্তাটি রেখে হঠাৎ উধাও হয়ে যান ওই ব্যক্তি। দৃশ্যটি ধরা পড়ে সিসিটিভি ফুটেজে।
স্থানীয়দের চোখে পড়ে সেই পরিত্যক্ত বস্তা। সন্দেহভাজন মনে হওয়ায় তারা ‘৯৯৯’-এ ফোন করেন। পুলিশ এসে বস্তাটি খুলতেই দেখা যায় দুই হাত, দুই পা ও মাথাবিহীন এক নারীর দেহাবশেষ। গা শিউরে ওঠে উপস্থিতদের।
তদন্তে নামা পুলিশ মরদেহের সঙ্গে থাকা একটি মোবাইল রিচার্জ কার্ড পায়। সেটির সূত্র ধরে শনাক্ত হয় ফোন নম্বর ও ব্যবহারকারী বিথী আক্তারের পরিচয়। তার স্বজনদের খুঁজে বের করে পুলিশ জানতে পারে, বিথী এবং তার ছেলে রাফসান- দুজনেই কয়েকদিন ধরে নিখোঁজ। কল রেকর্ড ঘেঁটে পুলিশ দেখে, বিথীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কথা হতো মহিউদ্দিন হাওলাদার ওরফে শিমুল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে, যিনি বিথীর সাবেক স্বামী।
জুরাইন থেকে শিমুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করে, গত সাত বছর আগে বিথীকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। তিন বছরের মাথায় তাদের তালাক হয়। পরে বিথী নতুন করে বিয়ে করেন রুবেল নামের এক ব্যক্তিকে, যাঁর ঘরেই জন্ম নেয় ছোট্ট রাফসান। অপরদিকে, শিমুলও দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন কদমতলীর জুরাইনে।
তবে কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিথীর সঙ্গে আবারও যোগাযোগ হয় শিমুলের। এরপর বিথী তার বর্তমান স্বামীকে জানিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মিরেরবাগ এলাকায় একটি সাবলেট বাসা ভাড়া নেন কাপড়ের কারখানার নাম করে। সেখানেই নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হতো শিমুলের সঙ্গে। তবে তাদের কথাবার্তা একসময় বিবাদে রূপ নেয়, যা রূপ নেয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞে।
ঘটনার দিন (২৫ এপ্রিল) সকালে বিথী পুনরায় বিয়ের জন্য শিমুলকে চাপ দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শিমুল প্রথমে বিথীকে গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পাশের ঘরে থাকা শিশু রাফসান ঘটনাটি দেখে ফেলায় তাকেও গলা টিপে হত্যা করেন।
এক পর্যায়ে বাসার অন্য রুমে থাকা সাবলেট তরুণী নূপুর ঘরে ঢুকে দুইটি মরদেহ দেখে ফেললে তাকেও শিমুল একইভাবে হত্যা করেন।
এরপর ঠান্ডা মাথায় তিনটি লাশই বাথরুমে নিয়ে ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করেন শিমুল।
প্রথমে তিনি শিশুপুত্র রাফসানের মরদেহ ছয়টি টুকরো করেন এবং সেগুলো বস্তাবন্দি করে কেরানীগঞ্জের বেয়ারা এলাকার একটি ঝোপের মধ্যে ফেলে দেন। এরপর বিথী ও নূপুরের দেহাবশেষ বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়। বিথীর দেহের ৮ থেকে ১০টি অংশ এবং নূপুরের হাত-পা ও মাথা একই বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেন। দুই নারীর মাথা ও নূপুরের দেহাবশেষ একসঙ্গে বস্তায় করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
ঘটনার আলামত ধ্বংস করতে ব্যবহৃত ছুরিটিও ফেলে দেন নদীতে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে ঘটিয়েছে শিমুল। তার কাছ থেকে পাওয়া স্বীকারোক্তি ও তথ্য অনুযায়ী আমরা মরদেহের বেশিরভাগ অংশ উদ্ধার করেছি।”
তিনি আরও জানান, “আমাদের চৌকস টিম সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তের গতিবিধি শনাক্ত করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আমরা বস্তাবন্দি মরদেহের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করেছি। এখনও দুই নারীর মাথা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।”
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন,মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় এর আগেও মামলা হয়েছে। যেহেতু আসামির দেখানো স্থান থেকে আজ শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে সেহেতু আজ আরও একটি হত্যা মামলা হচ্ছে। আশা করি আগামীকাল আসামি আদালতেও স্বীকারোক্তি দেবে।
নিহত বিথীর বড় বোন বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। সোমবার (২৮ এপ্রিল) শিশুপুত্র রাফসানের মরদেহ উদ্ধারের পর আরও একটি মামলা নেওয়া হয়েছে।
বিথীর বর্তমান স্বামী রুবেল গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের বাড়ি শুভাঢ্যা উত্তরপাড়া এলাকায়। কিছু দিন আগে বিথী বলল সে কাপড়ের কারখানা চালু করবে, তাই মীরেরবাগ এলাকায় বাসা ভাড়া নিবে। আমি তাকে না করিনি। সেখানে সে একটি সাবলেট বাসা ভাড়া নিয়ে আমাদের ছেলে রাফসানকে নিয়ে থাকত। কিন্তু সেখানে যে তার আগের স্বামীর যাতায়াত ছিল, সেটা আমার জানা ছিল না। আমি এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার চাই।”